Monday, April 23, 2012

দাকাক্কা

মুক্তিযোদ্ধাদের একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আটপাড়া গিয়েছিলামঢাকা থেকে এক তারকা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অতি সংক্ষিপ্ত কিছু কথা বলেছিলেন, যা আমার মিনি টেপরেকর্ডের ক্যাসেটে রেকর্ড করে রেখেছিলাম বক্তব্যটা ছিল এরকম- "আমাদের দেশে এমন অনেক শিশু আছে যাদের জীবন কাটে, অনাদরে, অনাহারে, অযত্নেতাদের পড়নের কাপড় জোটেনা, অসুক হলে ডাক্তার মেলেনাআনন্দ বঞ্চিত ওইসব শিশুরা সারাদিন শুধু খাটে আর খাটেধনীর শিশু জ্বর হলে ডাক্তার আসেকিন্তু গরীব শিশুরা
সামান্য সেবাটুকুও পায়নাধনীর শিশুরা দোলনায় ঘুমায় আর গরীব শিশুরা ঘুমায় বস্তিতে, রাস্তায়-ফুটপাতে, গাছতলায়এর জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি..............।"
বক্তৃতা দেবার সময় ছেঁড়া প্যান্ট, গায়ে ময়লা গেঞ্জি, কাঁধে ঝোলানো অনেক দিনের পুরানো কাপড়ের ব্যাগ পরিহিত একটা লোক আমার ডান পাশে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে বলতে লাগলেন সব মিথ্যা কথা, সব ধান্দাবাজতারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- আপনি মুকুলের ছোট ভাই না ?
আমি বললাম জী
আপনি কে ?
আমি হলাম নারায়ন চৌহান, আপনাদের গ্রামের
এবার নিজের চেয়ারটা সামনে এগিয়ে দেই বসার জন্যতিনি বসবেন নাকোনমতেই বসবেন নাএকপর্যায়ে জোর করে বসিয়েছি
এবার বলুন আপনার পরিচয়টা ?
আপনাদের গ্রামের বাজারের পূর্বপাশে গাঙের পাড়ে প্রথম বাড়ীটাই আমাদের
আমরা মুচারআমরা ছোটজাতের মানুষ, তাই আমাদের কেউ দাম দেয় নাআমি একজন মুক্তিযোদ্ধাসমাজটা বদলানোর জন্যই তো যুদ্ধ করেছিলামদেশ স্বাধীন হলে ওই ঘুনেধরা সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তন হবেকতকিছু পাবো, মোটা ভাত, মোটা কাপড়সব রূপকথার গাল গল্পওই যে লোকটা কিছুণ আগে ভাষণে
বলল- শিশুদের কথা, সব ভাওতাবাজিমুচার বলে আজ কেউ আমাকে চেয়ারে বসতে দিল নাচেয়ে দেখি নারায়ন দার চোখ থেকে জল পড়ছেনারায়নদার ডান হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে পুতুলের মতো লালটুকটুকে একটা সুন্দর মেয়েকিন্তু শরীরের জাঁমাটা অপরিস্কার এবং ছোট ছোট তালি যা হাতের সুঁই-সুতো দিয়ে সেলানো থাকায় ওই সোন্দর্যকে কে জানি ঢেকে রেখেছে- আমার তাই মনে হলওই সময় আমাদের টীমের একজন আমাকে ডাকছে এখনি তেলিগাতি হয়ে মদনে আরেকটা অনুষ্ঠানে যেতে হবেদাদাকে বললাম আজ থাক, আরেক দিন কথা হবে
সেদিন নারায়ন দাকে এভাবেই দেখেছিআজ একটা বিয়েতে গ্রামের বাড়িতে এসেছিবাজারের দিকে যাচ্ছি- গরুর দুধের চা খেতেদোকানের সামনেই দাঁড়িয়ে অন্য আরেকজনের সাথে কথা বলছিলেন নারায়নদাআমি চা খাচ্ছি আর নায়ারনদাকে ল্য করছিদু'চুমুক চা খেয়েই তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালামআমাকে দেখে তিনি বললেন কখন এসেছেনচলেন গরীব খানায় যাইমেয়েটা সবসময় আপনার কথা বলেবাড়ীতে গিয়ে যা দেখলাম
বর্ণনা করার মত নয়দুর্গদ্ধময় বিষাক্ত পরিবেশশিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার যেন তাদের কাছে অলীক বস্তুভিন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠা এ পাড়ার মানুষদের আজ বেঁচে থাকাটাই বিশাল চ্যালেঞ্জ গিয়ে দেখি আট-নয় বছরের একটা মেয়ে হাল আমলের রেডিও তে গান শুনছেগানের বাণী আমার হৃদয়ে ভীষন নাড়া দেয়
"বড়ো আশা ক'রে এসেছি গো, কাছে ডেকে লও,
ফিরায়ো না জননী
দীনহীনে কেহ চাহে না, তুমি তারে রাখিবে
জানি গো ....................."
মেয়েটার গায়ের রং উজ্জ্বল ফর্সাগায়ে ময়লা কাপড়সেদিন লালটুকটুকে পুতুলের মতো যে বাচ্চা মেয়েটা দেখেছিলাম সেই মেয়েটিআমাকে দেখে দৌড়ে আসলগানটা তখনও রেডিও তে বাজছিলআমাকে দেখে সে বলল- তুমি গান শোনতোমার জন্য বসার কিছু নিয়ে আসিওদিকে নারায়নদা তাঁর স্ত্রীকে ডাকতে থাকলো ওমিতার মা দেখ কাকে নিয়ে এসেছিনারায়নদার স্ত্রী মূল ঘরের পিছনে বেড়া লেপছিলচারদিকে দাড়ির বেড়াদাড়িগুলো অনেক দিনের পুরানোকিছু কিছু পরে যাচ্ছেতার ওপর ব্যর্থ লেপের চেষ্টামেয়েটা কিছু না পেয়ে প্রায় অর্ধেক ছিন্নভিন্ন একটা মোকতার পাটি এনে বলল- তুমি তো সাহেব মানুষএতে কি বসবে?
আমি এতেই বসে বললাম- তোমার নাম কী?
মিতা
-মিতা নামটা আমার কাছে কেমন কেমন লাগে
- 'মৌমিতা' ডাকলে কি রাগ করবে?
-হাসতে হাসতে বললো মা মা দেখ আমাকে কি বলে ডাকে
এরই মধ্যে মেয়েটা বলে ফেলল আমাকে মৌমিতা ডাকলে তোমাকে দাকাক্কা ডাকবোএমন সময় আমার বুক থেকে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বের হলওদিকে নারায়নদার স্ত্রী একটা মাটির পাত্রের মধ্যে কিছু লাড়ু এনে আমাকে দিয়ে বলল- দাদা আমরা গরীব মানুষআমাদের বাড়িতে তো কেউ আসেনাআমরা ছোটজাতআমাদের এখানে কেউ আসলে না কি মান সম্মান থাকে নাআপনে আসছেন আমি কত যে খুশী হয়েছি তা এমুখ দিয়ে বলার ভাষা আমার নেইআমার চেয়ে মেয়েটা বেশী খুশী হয়েছেভগবান আপনাকে অনেক দিন বাচিয়ে রাখুনএরই মধ্যে আমার দৃষ্টি চলে যায় ঘরের ভিতরঢোলক, লাউয়া, ডুগডুগী, কমক, চইট্যা, স্বরাজ, খোল-করতাল এগুলো লোকজ বাদ্যযন্ত্রএগুলো আমি পূর্ব থেকেই চিনতামআমি কথা প্রসঙ্গে বললাম- ঘরের ভেতর এ যন্ত্রগুলো কার? কেউ কি গানটান করেনারায়ানদার স্ত্রী বলল- মিতামিতা খুব ভাল গান গাইতে পারেনারায়নদা বললেন- ওই বাদ্যযন্ত্রগুলো মুক্তিযুদ্ধকালীন আমার কমান্ডার আব্দুল হাসেম দিয়েছিল, আমার মেয়ে ভাল গান গাইতে পারে, তা লোকমুখে শুনেআমি মৌমিতাকে বললাম- একটা গান শুনাবে? মৌমিতা বলল তোমাকে শোনাব না তো কাকে শোনাব! নারায়নদা টুগটুগী, বউদি করতাল আর মৌমিতা লাউয়া বাজিয়ে গান শুরু করলসুর-তাল, কন্ঠ মাধুর্য এবং লোকজ যন্ত্রসংগীতের সমন্বয়ে গানটা অপূর্ব ধারায় এগিয়ে চললোসুরের দোলায় আমি নিজেই দুলতে লাগলামহারিয়ে গেলাম এক অজানা অধ্যায়েমনে মনে ভাবতে লাগলাম যাদের দিনে এক বেলা ভাত জোটেনা, তথাকথিত সমাজ থেকে নিঃগৃহীত বঞ্চিত তাদের মধ্যে এ জমজমাট সৃজনশীল মনোভাব কিভাবে জন্মনিল? দূর থেকে আমার চাচাতো অগ্রজ ভাই ডাকছে ওই বরকতওই বরকত এদিকে আয় একটা খবর আছেআমি বললাম- এবার আসিএমন সময় নারায়নদার স্ত্রী বললো- দাদা আমরা খুব কষ্টে আছিএকবেলা ভাত জুটলে, তিনবেলা জোটে নাভাতের জন্য মেয়েটা স্কুলে যেতে পারছেনাগানও চর্চা করতে পারছেনামেয়ের বাপকে যদি একটা চাকুরীর ব্যবস্থা করে দিতেনদেশে আপনার কত নাম ডাক! চেষ্টা করে দেখিএ বলে আমি চলে এলাম
পাঁচদিন পর মৌমিতার একটা চিঠি আসে ডাকে
আমার পূজনীয় দাকাক্কা
তুমি সেই যে চলে গেলে আমার আর কোন খবর নাওনিসামনে আসলেই ওই ছোট জাতের মানুষদের প্রতি করুণা হয়, তাই নয় কী! মনে মনে ভেবেছিলাম তোমার সঙ্গে আর কথা বলবনাকিন্তু তা পারিনিপারিনি বলেই তোমাকে লিখছিসামনে পৌষ মাসআমাদের বাড়িতে পৌষ সংক্রান্তি উপলে অনুষ্ঠান হবেমা পাটিসাপটা, চিতই পিঠে বানাবেআসবে কিন্তুঅনেকবার পত্রটা পড়লামসাত-আট বছরের মেয়েমাত্র টুতে পড়েহাতের লেখা কত চিমকারসাজিয়ে গুছিয়ে লেখা বানানেও ভুল নেইভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলামঘুমিয়েও নিস্তার নেইস্বপ্নে মৌমিতার ছায়াআমার সামনে পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে বলছে
আমাকে কেউ আদর করে নাএমনকি স্কুলের আপারাওতাঁদের স্কুলের ভিতর-বাইরে আদাব দিলে ভালোমন্দ জিজ্ঞাস করে নাতাই আমাদের পাড়ার অনেক ছেলে মেয়ে স্কুল ছেড়ে দিয়েছেআমার জীবনে সর্বপ্রথম তোমাকেই দেখলাম আমাদের বাড়ীতে নাড়ু খেতেমাকে বলেছিলাম মা আমাদের বাড়িতে কি দাকাক্কা ছাড়াও কোন শিতি নামী দামী মানুষ এসে কখনো নাড়ু খেয়েছেমা মুখটা কালো করে বলেছিল দূর পুড়ামুখি! তোরা কী ব্রাহ্মন বংশের, যে তোদের বাড়ীতে নামী-দামী মানুষ এসে তোদের খোঁজ নেবেতোরা মানুষ নাতোরা জঙ্গলের প্রাণী ও নাজঙ্গলের প্রার্ণীকেও তো মানুষ দেখতে যায়! তোরা তার চেয়েও নিকৃষ্ট
প্রভাতের আলো তখনও স্পর্শ করেনি, কিন্তু ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে শেষ রাতের অন্ধকারসে ভয়ানক অদ্ভুত এক সময়আর সেই ভয়ানক অদ্ভুত সময়টাতে মহাকালের বুক চিরে এমন এক দৃশ্য আমার সামনে উন্মোচিত হয়েছিল; যার শ্রোতা বুঝি আমি একাইএকা কেবল মাত্র আমিঅতপর আমি এবং আমি
হঠা আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়চেয়ে দেখি সকাল হয়ে গেছেপ্রকৃতিকে কেমন জানি মনে হচ্ছিলগুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছেদুপুর বেলায় পিওন একটা চিঠি দিয়ে গেলচিঠিটা খুলে দেখলাম নারায়নদার চিঠি
দাদাবাবু,
নমস্কারআমার মনে হয় মৌমিতার মা ও আমি বেশিদিন বাঁচবনাআমরা মরে গেলে মেয়েটাকে আপনি নিয়ে যাবেনআপনার মত করে মানুষ করবেনমৌমিতাকে গান থেকে দূরে রাখবেনতবে এটা আমার কথা নয়মৌমিতার মার কথা
ইতি
চিরঅধম
নারায়ান চৌহান
চিঠিটা পাঁচদিন আগের লেখাবাসায় আমি একাআমার ঘরের সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ করে টিভির অনুষ্ঠান দেখছিহঠা টিভির পদায় একটা বুলেটিন আমাকে দুমড়ে মুচড়ে দিলবুলেটিনটা ছিল এরকম 'আজ সকাল ৮.৩০মিনিটে নেত্রকোণা জেলার আটপাড়া উপজেলায় এক ভয়বহ ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগছিল প্রচন্ডবহু য়তি হয়েছে, তানিকভাবে আহত এবং নিহতের পরিমাণ এখনো জানা যায়নিকারণ অত্র উপজেলার সঙ্গে সমগ্র দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে'
তখন মোবাইল ছিল না বলে যোগাযোগ করতে পারিনিতারপরও নাগরপুর থেকে নেত্রকোণায় টেলিফোনে খবর নিয়ে যা জানলাম আঁতকে উঠার মতোনাগরপুর থেকে টাঙ্গাইল যতণে আসা যায় মনে হয় ততণে আমেরিকা চলে যাওয়া যায়সেই পথ পারি দিয়ে নেত্রকোণা সদর হাসপাতালে চলে এলামখুঁজতে খুজতে পেয়ে গেলাম মৌমিতাকেমারাত্নক আহত হয়েছিল সেতাদের পাড়ায় ২০০জন মানুষ ছিল১৫০জনই মারা গেছেমৌমিতার বাবা মাও মারা গেছেলাশ খুঁজে পাওয়া যায়নিচারদিক থেকে মানুষ পানির স্রোতের মতো তিগ্রস্ত গ্রাম গুলোতে দল বেঁধে আসে সহমর্মিতা জানাতেকেউ কেউ আর্থিক সহযোগিতার হাতও বাড়িয়ে দেয়মৌমিতার মাথা ফেটে গেছেরেন্ট্রি গাছের নীচে চাপা পড়ে ভেঙ্গে গেছে পাঁজরের দু'টি হাড়অভ্যন্তরীন কিছু জখমও ছিলসবমিলিয়ে পুরো তিনটা মাস লেগেছিল তার সুস্থ হতেরাজ্যের শঙ্কা নিয়ে মৌমিতা আমার দিকে তাকিয়ে বলল- আমি কোথায় যাব ? আমার হবে কি ? দাকাক্কাএরই মধ্যে আমার বুকটা ধক করে উঠল, চোখ ভিজে এলণা ডাক্তার এসে বলল- এখন আপনিই তো ওর অভিভাবক তাহলে ওই ফরমে একটা স্বার করে মৌমিতাকে নিয়ে যানওদিকে চিন্তায় আমার ঘুম নেইওই মেয়েটা কে নিয়ে কোথায় যাব ? কী করব ? নানান চিন্তায় খাওয়া-দাওয়া-ঘুম যেন পালিয়ে গেছেবন্ধু-বান্ধব-পরিবারের সবারই উক্তি তোর কী হয়েছে ? আমি কারো কোন সঠিক জবাব দিতে পারিনাআর ওদিকে মা, বাবাকে হারিয়ে মৌমিতা নিশ্চুপনির্বাক দাঁড়িয়ে থাকেকান্নার ভাষা হারিযে ফেলেছে সেমৌমিতাকে কিছুদিন মোহনগঞ্জ এক বন্ধুর বাসায় রাখলামতারপর সাহস করে ঢাকার এক আবাসিক স্কুলে ভর্তি করে দিলাম কাসে টুতেপ্রতিমাসে তিন হাজার টাকা দিতে হবেটাকাটা সংগ্রহ করতে আমার খুব বেগ পেতে হতকারণ আমার পরিবারের কেউ ওই ঘটনাটি জানতো নাঅতিরিক্ত তিন হাজার টাকা আমাকে প্রতিমাসে সংগ্রহ করতে হতোওই অতিরিক্ত টাকা সংগ্রহ করা নিয়ে পরিবার-বন্ধুমহলসহ নানাজনের কাছে নানান প্রশ্নের সম্মূখীন হতে হয়েছে
মনে পড়ে যেদিন মৌমিতাকে ঢাকার আবাসিক স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে গিয়েছিলাম স্কুলের অধ্য দিলশাদ চৌধুরী মৌমিতাকে বললেন তোমার বাবার নাম কী ?
আবুল বরকত পাহা
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম মৌমিতার কণ্ঠশুনে বুঝতে পারেন ও মেয়েতো ভীষণ ব্রিলিয়্যান্টম্যাডাম কিছু প্রশ্ন করলেন, মৌমিতা সব গুলোর সঠিক উত্তর দেয় যার দরুণ দিলশাদ ম্যাডামের মৌমিতার প্রতি প্রথমদিনেই দুর্বলতার একটা লণ ধরা পড়েগানে, নৃত্যে, আবৃত্তি ও অভিনয়ে সারা স্কুল মাতিয়ে রাখে মৌমিতা স্কুলের চারিদিকে শুধু মৌমিতামৌমিতামৌমিতাসংসার এবং নিজ পেশার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ঢাকায় মৌমিতার সংগে দেখা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনাএরই মধ্যে মৌমিতা বড় হয়ে উঠতে থাকলোচেহারাও আরো সুন্দর থেকে সুন্দর হতে থাকলো৫ম, ৮ম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি, এস.এস.সি. ও এইচ.এস.সিতে এ প্লাস পেলযন্ত্রপাতির বহুল প্রচলন ও ব্যবহারের ফলে মানুষের জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে ওই ধারাবাহিকতায় মোবাইল এসে গেল বাংলাদেশেএখন প্রতিদিন মৌমিতার সঙ্গে মোবাইলে কথা হয় আমি তখন কুলিয়ারচরদিলশাদ ম্যাডাম একদিন মোবাইলে বলল- আপনার মেয়েকে এবার নিয়ে যানআমি কুলিয়ারচর থেকে ঢাকায় গিয়ে মৌমিতাকে আরেকটি হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে চলে আসিমৌমিতা বুয়েট মেডিকেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারভিউ দিয়ে সবগুলোতেই মেধার স্বার রাখে
মৌমিতাকে নিয়ে আরেকটি স্মৃতি না বললে তা অপূর্ণতাই থেকে যাবেস্মৃতিটি এরকম- মৌমিতা যখন নবম শ্রেণীতে পড়তো তখন দিলশাদ চৌধুরী একদিন আমাকে ফোন করে দ্রুত ঢাকায় আসতে বলেআমি প্রচুর ব্যস্ততার পরও ঢাকায় আসিতিনি অফিস রুমে আমার সঙ্গে কিছু কথা বলেনকথাগুলো এরকম- বরকত সাহেব আপনার মেয়েতো সবদিক দিয়ে বুদ্ধিমতিঅনেকদিন গত হল মৌমিতার বিরুদ্ধে কোন প্রকার অভিযোগ আসেনিটেলিফোনে আপনাকে ব্যাপারটা বলতে পারতামকিন্তু আপনি অনেকদিন যাব ঢাকায় আসেন নাঢাকায় আসা হল মেয়েকেও এক নজর দেখলেনসমস্যাটাও জানলেনব্যাপারটা হল মৌমিতা রাত বারটার পর উচ্চস্বরে গান গায়গানগুলোও নাকি পঁচা
আমি বললাম ব্যাপারটা দেখছিএরই মধ্যে মৌমিতা হাঁপাতে হাঁপাতে তিনতলা থেকে নিচতলায় এসে বলল- দাকাক্কা! দাকাক্কা! তারপর মৌমিতাকে নিয়ে ওয়েটিং রুমে চলে গেলাম
ওই দাকাক্কা ডাক নিয়ে দিলশাদ চৌধুরীসহ মৌমিতার বন্ধু, সেখানকার অফিস স্টাফগণ নানা মন্তব্য করলোদিলশাদ চৌধুরী আধুনিক উচ্চশিতি হওয়ায় ব্যাপরটা নিযে এত ঘাটাঘাটি করেননিআমি মৌমিতাকে বললাম- তুমি রাতে উচ্চস্বরে গান গেয়ে অন্যের অসুবিধা কর কেন?
-আমি তো তোমার গান গুলোই গাই ?
কোন গান ?
সে বার তোমার ডায়রিটা যে রেখে গিয়েছিলে, সেখানে তো গান গুলো আছে
খোন্দকার নূরুল আলমের:
'কে যেন আজ আমার চোখে
নতুন আলো জ্বালিয়ে দিল ....................'
মাহমুদুন্নবীর:
'তুমি যে আমার কবিতা
আমার বাশীর রাগিনী............'
আমি মৌমিতাকে গান গাইতে নিষেধ করলামঅনেক বুঝালামকিছু টাকা হাতে দিয়ে দিলশাদ চৌধুরীর রুমে ঢুকলামতিনি বসতে বললেনআমি বসলামম্যাডামকে বললাম মৌমিতা আর গান গাবেনাতবে আমার একটা প্রশ্ন: মাহমুদন্নবীর গান পঁচা হলে ভালো শিল্পীটা কে?
-        ম্যাডাম বললেন- শামীম-কালামের গানই তো আজ কালকার টিন এজররা শুনে
-        আমি বললাম সব সুরকার, সব গীতিকার সব কন্ঠশিল্পীদের প্রতি আমার বিশ্বাস আছেওই উন্নত প্রযুক্তির যুগে আরো উন্নত মানের গান আমরা নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের কাছ থেকে আশা করি গানশুধু চাই একটু ধৈর্য, চাই গানের প্রতি দরদ, সে গুলো কী নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে আছে
-        ম্যাডামের উত্তর, আরো সহজ ভাষায় বলুন
-        আমি মনে করি গান তখনই জনপ্রিয় হয়, যখন গানগুলো সব বয়সি মানুষের মুখে মুখে ওঠে আসেযখন গান গুলো একজন অবসর মানুষের সঙ্গী হয়, দুঃখ-কষ্ট-হাসি-আনন্দের সঙ্গী হয়
-        আপনার কথাগুলো শুনতে ভালোই লাগছেআপনার সময় থাকলে আরো কিছু বলুন
গান মানে স্থুল ভাবনা নয়, গান মানে স্নু চিন্তাগান মানে শুধু নাচানাচি নয়, গান মানে উপভোগ করা, অনুভব করা
তাহলে এখনকার গান কী গান নয়?
আমি তা বলছি নাআধুনিক গান মানেই তো বাণী প্রধান গানগানের বাণীতে অশ্লীলতা এলো কেন ? পুরানো সেই গানগুলো বিশেষ করে মৌমিতা যে গানগুলো গায় সে গান গুলো রিমিঙ্ হচ্ছে কেন? হালের গানের কদর কমছে কেন? আজ যে গান হিট, বছর কয়েক পর সে গানগুলো তন্ন তন্ন করেও খোঁজ পাওয়া যায় নাঅথচ যে গানগুলো নতুন প্রজন্ম পঁচা বলে তাদের মুখেই সে গান শোন যায়?
ম্যাডামের প্রশ্ন, একটা দৃষ্টান্ত দেন
"ওরে নীল ধরিয়া ............" ওই ধরনের অনেক গান আছেযেগুলো গুন গুন করে বুড়া-বুড়ি, যুবক-যুবতী, তরুণ-তরুণী, শিশু-কিশোর সবাই একটু আধটুকু গায়
ম্যাডামের উত্তর- আমি শিকগান নিয়ে এত চিন্তা কখনো করিনি
তবে আমার মনে হচ্ছে আপনি একজন বিশুদ্ধ সংগীত বিশারদসে হিসাবে আপনাকে সাধুবাদ জানাইওদিকে দূর থেকে মৌমিতা সব শুনছিলআমার এ কথা গুলো শুনে মৌমিতার ধ্যান ধারণায় আরো পরিবর্তন এল
একদিন মৌমিতা আমাকে ফোনে বলল- দাকাক্কা আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে ভর্তি হবআমি হ্যাঁ স্বরে জবাব দিলামতবে মনে মনে কষ্ট পেলামআমি চেয়েছিলাম ও ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হোক
এরই মধ্যে মৌমিতা আমাকে টাকা পাঠাতে নিষেধ করলউল্টো আমাকে টাকা দিতে চাইলকষ্ট পাবে বলে আমি বললাম ঠিক আছে আমার নেত্রকোনা পূবালী ব্যাংকের শাখায় তুমি টাকা পাঠাবেতোমার মোবাইলে এসএমএস করে একাউন্ট নম্বর পাঠিয়ে দিচ্ছিআমি আরো বললাম তুমি টাকা কিভাবে উপার্জন করছ? সে বলল দুটি ভালো টিউশনি পেয়েছি
এবার অর্নাসের ফল বের হলপ্রথম শ্রেণীতে প্রথমওর বন্ধু মহল শিকসহ সবাই ভীষণ খুশীআমি সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিকদের নিষেধ সত্ত্বেও মৌমিতা বিসিএস পরীক্ষা দিলওই প্রথম মৌমিতার সঙ্গে আমার সামান্য মতবিরোধ দেখা দিলসে এখন নেত্রকোণায় আসতে চায়? তার কিছু দরকারী কাজ আছেআমি নিষেধ করলামসে নিষেধ মানলহঠা একদিন মৌমিতা ফোনে বলল এইমাত্র বিসিএস পরীার ফল ইন্টারনেন্ট থেকে জেনেছিআমি সহকারী জজ হিসাবে নিয়োগ পেয়েছিতার কয়েকদিন পর আবার ফোনে জানাল ১৯ অক্টোবর ঢাকায় চাকুরীতে যোগদান করবে
উচ্চবংশ পরিচয়ে মানুষ কখনো মর্যাদাবান হয় নাবরং কর্মময় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্যে মানুষ গৌরবান্বিত হয়কাজের মাধ্যমে মানুষ নিজের জীবনকে সফল করে তোলেআবার কর্মের অবদানে দেশ ও জাতির উন্নতি বিধান করে চলেআর সেই ফলপ্রসূ কাজের জন্যেই মানুষ মানুষের স্মৃতিতে অমর হয়ে থাকেমৌমিতার জজ হবার কথা শোনে আমার তাই মনে হলআরেকটি বিষয় ওর মধ্যে দেখেছি অবাধ স্বাধীনতা পাবার পরও সে ইঁচড়ে পাকা হয়ে যায়নি
দু'দিন পর আবার ফোন এল ১১ অষ্টোবর কঙ্বাজার যাবে একটা গানের উসবেমাল্টিমিডিয়া কোম্পানির সৌজন্যে 'মৌমিতার একক গানের সন্ধ্যা' নামে এক জমজমাট আসরেজাকজমটক পুর্ণ অনুষ্ঠানটা হবে পাঁচতারা হোটেলের বল রুমেমৌমিতার মার কথা মনে পড়লসে তো মৌমিতাকে গান করতে নিষেধ করেছিলআমি এক মহাসমস্যায় পড়লামমৌমিতাকে বললাম পরে ফোন করএকটু পর আবার ফোন করলমৌমিতা বলল- তুমি তো আগে কখন আমার সঙ্গে এমন করনিতবে আজ কেন এমন করছআমাকে নিয়েই তো ওই অনুষ্ঠানআমি তো কথা দিয়েছিকিছুদিন পর জজ হব, আর তখন মানুষে বলবে কথা দিয়ে যে কথা রাখেন না, সে আবার কিসের জজ! কিসের বিচারক? নিজের হোক কিংবা পালিত হোক সন্তানের মত কী আর কোন প্রিয় বস্তু আছে এ জগতেভাবতে গিয়ে দ্রুত গতিতে চোখ দিয়ে জল প্রবাহিত হতে থাকল
আমার মনে হচ্ছে- কে যেন আমার বুকে ছুরি মারছেসেই অবস্থায় মৌমিতাকে যাবার অনুমতি দিলাম এবং আমার বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন কঙ্বাজারের বন্ধু সুলতানা ইয়াছমিন পিনার মোবাইল নম্বর দিয়ে সেখানে পৌঁছে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললামএবার আমি পিনার কাছে ফোন করে বিস্তারিত জানালাম
১২ তারিখ সন্ধ্যা সাতটায় পিনা আমাকে মোবাইলে জানায় সাগর দেখতে গিয়ে মৌমিতা টেউয়ের ধাক্কায় সমুদ্রে তলিয়ে গেছেখবরটা পাওয়া মাত্রই আমার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হবার উপক্রম হলআমার কাছে পৃথিবীর সবকিছু অন্ধকার মনে হলএক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম১৫অষ্টোবর সকাল নয়টায় আমার জ্ঞান ফিরলজাতীয় একটা পত্রিকা আমার পাশেই ছিলপত্রিকায় প্রথম পাতার প্রথম কলামের শিরোনাম- 'সদ্য বিসিএস নিয়োগ পাওয়া সহকারী জজ মৌমিতা পাহা কঙ্বাজার সমুদ্র সৈকতে নিখোঁজ'ঘটনাটা আমার পরিবার ঘনিষ্ট আত্মীয় বন্ধু মহল কাউকে বলেনিমৌমিতার দাকাক্কা ধ্বনি এখনও আমার কানে ধ্বনিত হয়, আর সেই পুতুলের মতো সুন্দর মূর্তি এখনও আমার হৃদয় পটে আঁকা রয়েছেআজ আমি বড়ই কান্তবিধ্বস্তওই ঘটনাসমূহ আমাকে ভীষণ নাড়া দিচ্ছেরক্তচাপ বেড়ে যাচ্ছেকী করব? কী করা উচিত তা ভেবে না পেয়ে খুবই অসহায় বোধ করছিকী জানি সকলেই কী ঘুমিয়ে আছে? কেউ কী আমার মতো ভাবে না? জেগে নেই কি কেউই? মৃত্যুর ঠিক দু'মাস তিন দিন আগে মৌমিতা ভৈরবের পৌর মার্কেট থেকে আট হাজার দুইশত টাকা দিয়ে একটা নকিয়া ৩১১০ মোবাইল কিনে দিয়েছিলওর টিউশনির জমানো টাকা থেকে মোবাইলটা আমাকে গিফট করেছিলসঙ্গে তিনশত টাকা দিয়ে একটা মেমোরি কার্ডও দিয়েছিলআমি রবীন্দ্রনাথের 'তুমি কি কেবলই ছবি' গানটা বেশী শুনি বলে বলেছিল- তোমার মোবাইলে গানটা সেট করে দিয়েছিমন খারাপ হলে গানটি শুনবে
"তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা
ওই- যে সুদূর নীহারিকা
যারা করে আছে ভীড় আকাশের নীড়
ওই যারা দিবারাত্রি............."
এখন সুখে-দুঃখে, আনন্দ বেদনায় কী জানি কেন শুধু আমি ওই গানটাই শুনি

লিখেছেন : আবুল কাইয়ুম আহম্মেদ
মোবাইল : ০১৭১৬৩৪৯৭২৪                                   

                                              

No comments: