মুক্তিযোদ্ধাদের একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আটপাড়া গিয়েছিলাম। ঢাকা থেকে এক তারকা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অতি সংক্ষিপ্ত কিছু কথা বলেছিলেন, যা আমার মিনি টেপরেকর্ডের ক্যাসেটে রেকর্ড করে রেখেছিলাম বক্তব্যটা ছিল এরকম- "আমাদের দেশে এমন অনেক শিশু আছে যাদের জীবন কাটে, অনাদরে, অনাহারে, অযত্নে। তাদের পড়নের কাপড় জোটেনা, অসুক হলে ডাক্তার মেলেনা। আনন্দ বঞ্চিত ওইসব শিশুরা সারাদিন শুধু খাটে আর খাটে। ধনীর শিশু জ্বর হলে ডাক্তার আসে। কিন্তু গরীব শিশুরা
সামান্য সেবাটুকুও পায়না। ধনীর শিশুরা দোলনায় ঘুমায় আর গরীব শিশুরা ঘুমায় বস্তিতে, রাস্তায়-ফুটপাতে, গাছতলায়। এর জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি..............।"
সামান্য সেবাটুকুও পায়না। ধনীর শিশুরা দোলনায় ঘুমায় আর গরীব শিশুরা ঘুমায় বস্তিতে, রাস্তায়-ফুটপাতে, গাছতলায়। এর জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি..............।"
বক্তৃতা দেবার সময় ছেঁড়া প্যান্ট, গায়ে ময়লা গেঞ্জি, কাঁধে ঝোলানো অনেক দিনের পুরানো কাপড়ের ব্যাগ পরিহিত একটা লোক আমার ডান পাশে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে বলতে লাগলেন সব মিথ্যা কথা, সব ধান্দাবাজ। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- আপনি মুকুলের ছোট ভাই না ?
আমি বললাম জী।
আপনি কে ?
আমি হলাম নারায়ন চৌহান, আপনাদের গ্রামের।
এবার নিজের চেয়ারটা সামনে এগিয়ে দেই বসার জন্য। তিনি বসবেন না। কোনমতেই বসবেন না। একপর্যায়ে জোর করে বসিয়েছি।
এবার বলুন আপনার পরিচয়টা ?
আপনাদের গ্রামের বাজারের পূর্বপাশে গাঙের পাড়ে প্রথম বাড়ীটাই আমাদের।
আমরা মুচার। আমরা ছোটজাতের মানুষ, তাই আমাদের কেউ দাম দেয় না। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। সমাজটা বদলানোর জন্যই তো যুদ্ধ করেছিলাম। দেশ স্বাধীন হলে ওই ঘুনেধরা সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তন হবে। কতকিছু পাবো, মোটা ভাত, মোটা কাপড়। সব রূপকথার গাল গল্প। ওই যে লোকটা কিছুণ আগে ভাষণে
বলল- শিশুদের কথা, সব ভাওতাবাজি। মুচার বলে আজ কেউ আমাকে চেয়ারে বসতে দিল না। চেয়ে দেখি নারায়ন দার চোখ থেকে জল পড়ছে। নারায়নদার ডান হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে পুতুলের মতো লালটুকটুকে একটা সুন্দর মেয়ে। কিন্তু শরীরের জাঁমাটা অপরিস্কার এবং ছোট ছোট তালি যা হাতের সুঁই-সুতো দিয়ে সেলানো থাকায় ওই সোন্দর্যকে কে জানি ঢেকে রেখেছে- আমার তাই মনে হল। ওই সময় আমাদের টীমের একজন আমাকে ডাকছে এখনি তেলিগাতি হয়ে মদনে আরেকটা অনুষ্ঠানে যেতে হবে। দাদাকে বললাম আজ থাক, আরেক দিন কথা হবে।
বলল- শিশুদের কথা, সব ভাওতাবাজি। মুচার বলে আজ কেউ আমাকে চেয়ারে বসতে দিল না। চেয়ে দেখি নারায়ন দার চোখ থেকে জল পড়ছে। নারায়নদার ডান হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে পুতুলের মতো লালটুকটুকে একটা সুন্দর মেয়ে। কিন্তু শরীরের জাঁমাটা অপরিস্কার এবং ছোট ছোট তালি যা হাতের সুঁই-সুতো দিয়ে সেলানো থাকায় ওই সোন্দর্যকে কে জানি ঢেকে রেখেছে- আমার তাই মনে হল। ওই সময় আমাদের টীমের একজন আমাকে ডাকছে এখনি তেলিগাতি হয়ে মদনে আরেকটা অনুষ্ঠানে যেতে হবে। দাদাকে বললাম আজ থাক, আরেক দিন কথা হবে।
সেদিন নারায়ন দাকে এভাবেই দেখেছি। আজ একটা বিয়েতে গ্রামের বাড়িতে এসেছি। বাজারের দিকে যাচ্ছি- গরুর দুধের চা খেতে। দোকানের সামনেই দাঁড়িয়ে অন্য আরেকজনের সাথে কথা বলছিলেন নারায়নদা। আমি চা খাচ্ছি আর নায়ারনদাকে ল্য করছি। দু'চুমুক চা খেয়েই তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাকে দেখে তিনি বললেন কখন এসেছেন। চলেন গরীব খানায় যাই। মেয়েটা সবসময় আপনার কথা বলে। বাড়ীতে গিয়ে যা দেখলাম
বর্ণনা করার মত নয়। দুর্গদ্ধময় বিষাক্ত পরিবেশ। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার যেন তাদের কাছে অলীক বস্তু। ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠা এ পাড়ার মানুষদের আজ বেঁচে থাকাটাই বিশাল চ্যালেঞ্জ । গিয়ে দেখি আট-নয় বছরের একটা মেয়ে হাল আমলের রেডিও তে গান শুনছে। গানের বাণী আমার হৃদয়ে ভীষন নাড়া দেয়।
বর্ণনা করার মত নয়। দুর্গদ্ধময় বিষাক্ত পরিবেশ। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার যেন তাদের কাছে অলীক বস্তু। ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠা এ পাড়ার মানুষদের আজ বেঁচে থাকাটাই বিশাল চ্যালেঞ্জ । গিয়ে দেখি আট-নয় বছরের একটা মেয়ে হাল আমলের রেডিও তে গান শুনছে। গানের বাণী আমার হৃদয়ে ভীষন নাড়া দেয়।
"বড়ো আশা ক'রে এসেছি গো, কাছে ডেকে লও,
ফিরায়ো না জননী
দীনহীনে কেহ চাহে না, তুমি তারে রাখিবে
জানি গো ....................."।
মেয়েটার গায়ের রং উজ্জ্বল ফর্সা। গায়ে ময়লা কাপড়। সেদিন লালটুকটুকে পুতুলের মতো যে বাচ্চা মেয়েটা দেখেছিলাম সেই মেয়েটি। আমাকে দেখে দৌড়ে আসল। গানটা তখনও রেডিও তে বাজছিল। আমাকে দেখে সে বলল- তুমি গান শোন। তোমার জন্য বসার কিছু নিয়ে আসি। ওদিকে নারায়নদা তাঁর স্ত্রীকে ডাকতে থাকলো ওমিতার মা দেখ কাকে নিয়ে এসেছি। নারায়নদার স্ত্রী মূল ঘরের পিছনে বেড়া লেপছিল। চারদিকে দাড়ির বেড়া। দাড়িগুলো অনেক দিনের পুরানো। কিছু কিছু পরে যাচ্ছে। তার ওপর ব্যর্থ লেপের চেষ্টা। মেয়েটা কিছু না পেয়ে প্রায় অর্ধেক ছিন্নভিন্ন একটা মোকতার পাটি এনে বলল- তুমি তো সাহেব মানুষ। এতে কি বসবে?
আমি এতেই বসে বললাম- তোমার নাম কী?
মিতা
-মিতা নামটা আমার কাছে কেমন কেমন লাগে।
- 'মৌমিতা' ডাকলে কি রাগ করবে?
-হাসতে হাসতে বললো মা মা দেখ আমাকে কি বলে ডাকে।
এরই মধ্যে মেয়েটা বলে ফেলল আমাকে মৌমিতা ডাকলে তোমাকে দাকাক্কা ডাকবো। এমন সময় আমার বুক থেকে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বের হল। ওদিকে নারায়নদার স্ত্রী একটা মাটির পাত্রের মধ্যে কিছু লাড়ু এনে আমাকে দিয়ে বলল- দাদা আমরা গরীব মানুষ। আমাদের বাড়িতে তো কেউ আসেনা। আমরা ছোটজাত। আমাদের এখানে কেউ আসলে না কি মান সম্মান থাকে না। আপনে আসছেন আমি কত যে খুশী হয়েছি তা এমুখ দিয়ে বলার ভাষা আমার নেই। আমার চেয়ে মেয়েটা বেশী খুশী হয়েছে। ভগবান আপনাকে অনেক দিন বাচিয়ে রাখুন। এরই মধ্যে আমার দৃষ্টি চলে যায় ঘরের ভিতর। ঢোলক, লাউয়া, ডুগডুগী, কমক, চইট্যা, স্বরাজ, খোল-করতাল এগুলো লোকজ বাদ্যযন্ত্র। এগুলো আমি পূর্ব থেকেই চিনতাম। আমি কথা প্রসঙ্গে বললাম- ঘরের ভেতর এ যন্ত্রগুলো কার? কেউ কি গানটান করে। নারায়ানদার স্ত্রী বলল- মিতা। মিতা খুব ভাল গান গাইতে পারে। নারায়নদা বললেন- ওই বাদ্যযন্ত্রগুলো মুক্তিযুদ্ধকালীন আমার কমান্ডার আব্দুল হাসেম দিয়েছিল, আমার মেয়ে ভাল গান গাইতে পারে, তা লোকমুখে শুনে। আমি মৌমিতাকে বললাম- একটা গান শুনাবে? মৌমিতা বলল তোমাকে শোনাব না তো কাকে শোনাব! নারায়নদা টুগটুগী, বউদি করতাল আর মৌমিতা লাউয়া বাজিয়ে গান শুরু করল। সুর-তাল, কন্ঠ মাধুর্য এবং লোকজ যন্ত্রসংগীতের সমন্বয়ে গানটা অপূর্ব ধারায় এগিয়ে চললো। সুরের দোলায় আমি নিজেই দুলতে লাগলাম। হারিয়ে গেলাম এক অজানা অধ্যায়ে। মনে মনে ভাবতে লাগলাম যাদের দিনে এক বেলা ভাত জোটেনা, তথাকথিত সমাজ থেকে নিঃগৃহীত বঞ্চিত তাদের মধ্যে এ জমজমাট সৃজনশীল মনোভাব কিভাবে জন্মনিল? দূর থেকে আমার চাচাতো অগ্রজ ভাই ডাকছে ওই বরকত। ওই বরকত এদিকে আয় একটা খবর আছে। আমি বললাম- এবার আসি। এমন সময় নারায়নদার স্ত্রী বললো- দাদা আমরা খুব কষ্টে আছি। একবেলা ভাত জুটলে, তিনবেলা জোটে না। ভাতের জন্য মেয়েটা স্কুলে যেতে পারছেনা। গানও চর্চা করতে পারছেনা। মেয়ের বাপকে যদি একটা চাকুরীর ব্যবস্থা করে দিতেন। দেশে আপনার কত নাম ডাক! চেষ্টা করে দেখি। এ বলে আমি চলে এলাম।
পাঁচদিন পর মৌমিতার একটা চিঠি আসে ডাকে।
আমার পূজনীয় দাকাক্কা
তুমি সেই যে চলে গেলে আমার আর কোন খবর নাওনি। সামনে আসলেই ওই ছোট জাতের মানুষদের প্রতি করুণা হয়, তাই নয় কী! মনে মনে ভেবেছিলাম তোমার সঙ্গে আর কথা বলবনা। কিন্তু তা পারিনি। পারিনি বলেই তোমাকে লিখছি। সামনে পৌষ মাস। আমাদের বাড়িতে পৌষ সংক্রান্তি উপলে অনুষ্ঠান হবে। মা পাটিসাপটা, চিতই পিঠে বানাবে। আসবে কিন্তু। অনেকবার পত্রটা পড়লাম। সাত-আট বছরের মেয়ে। মাত্র টুতে পড়ে। হাতের লেখা কত চিমৎকার। সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা বানানেও ভুল নেই। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুমিয়েও নিস্তার নেই। স্বপ্নে মৌমিতার ছায়া। আমার সামনে পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে বলছে।
আমাকে কেউ আদর করে না। এমনকি স্কুলের আপারাও। তাঁদের স্কুলের ভিতর-বাইরে আদাব দিলে ভালোমন্দ জিজ্ঞাস করে না। তাই আমাদের পাড়ার অনেক ছেলে মেয়ে স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। আমার জীবনে সর্বপ্রথম তোমাকেই দেখলাম আমাদের বাড়ীতে নাড়ু খেতে। মাকে বলেছিলাম মা আমাদের বাড়িতে কি দাকাক্কা ছাড়াও কোন শিতি নামী দামী মানুষ এসে কখনো নাড়ু খেয়েছে। মা মুখটা কালো করে বলেছিল দূর পুড়ামুখি! তোরা কী ব্রাহ্মন বংশের, যে তোদের বাড়ীতে নামী-দামী মানুষ এসে তোদের খোঁজ নেবে। তোরা মানুষ না। তোরা জঙ্গলের প্রাণী ও না। জঙ্গলের প্রার্ণীকেও তো মানুষ দেখতে যায়! তোরা তার চেয়েও নিকৃষ্ট।
প্রভাতের আলো তখনও স্পর্শ করেনি, কিন্তু ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে শেষ রাতের অন্ধকার। সে ভয়ানক অদ্ভুত এক সময়। আর সেই ভয়ানক অদ্ভুত সময়টাতে মহাকালের বুক চিরে এমন এক দৃশ্য আমার সামনে উন্মোচিত হয়েছিল; যার শ্রোতা বুঝি আমি একাই। একা কেবল মাত্র আমি। অতপর আমি এবং আমি।
হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। চেয়ে দেখি সকাল হয়ে গেছে। প্রকৃতিকে কেমন জানি মনে হচ্ছিল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। দুপুর বেলায় পিওন একটা চিঠি দিয়ে গেল। চিঠিটা খুলে দেখলাম নারায়নদার চিঠি।
দাদাবাবু,
নমস্কার। আমার মনে হয় মৌমিতার মা ও আমি বেশিদিন বাঁচবনা। আমরা মরে গেলে মেয়েটাকে আপনি নিয়ে যাবেন। আপনার মত করে মানুষ করবেন। মৌমিতাকে গান থেকে দূরে রাখবেন। তবে এটা আমার কথা নয়। মৌমিতার মার কথা।
ইতি
চিরঅধম
নারায়ান চৌহান
চিঠিটা পাঁচদিন আগের লেখা। বাসায় আমি একা। আমার ঘরের সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ করে টিভির অনুষ্ঠান দেখছি। হঠাৎ টিভির পদায় একটা বুলেটিন আমাকে দুমড়ে মুচড়ে দিল। বুলেটিনটা ছিল এরকম 'আজ সকাল ৮.৩০মিনিটে নেত্রকোণা জেলার আটপাড়া উপজেলায় এক ভয়বহ ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগছিল প্রচন্ড। বহু য়তি হয়েছে, তাৎনিকভাবে আহত এবং নিহতের পরিমাণ এখনো জানা যায়নি। কারণ অত্র উপজেলার সঙ্গে সমগ্র দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।'
তখন মোবাইল ছিল না বলে যোগাযোগ করতে পারিনি। তারপরও নাগরপুর থেকে নেত্রকোণায় টেলিফোনে খবর নিয়ে যা জানলাম আঁতকে উঠার মতো। নাগরপুর থেকে টাঙ্গাইল যতণে আসা যায় মনে হয় ততণে আমেরিকা চলে যাওয়া যায়। সেই পথ পারি দিয়ে নেত্রকোণা সদর হাসপাতালে চলে এলাম। খুঁজতে খুজতে পেয়ে গেলাম মৌমিতাকে। মারাত্নক আহত হয়েছিল সে। তাদের পাড়ায় ২০০জন মানুষ ছিল। ১৫০জনই মারা গেছে। মৌমিতার বাবা মাও মারা গেছে। লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। চারদিক থেকে মানুষ পানির স্রোতের মতো তিগ্রস্ত গ্রাম গুলোতে দল বেঁধে আসে সহমর্মিতা জানাতে। কেউ কেউ আর্থিক সহযোগিতার হাতও বাড়িয়ে দেয়। মৌমিতার মাথা ফেটে গেছে। রেন্ট্রি গাছের নীচে চাপা পড়ে ভেঙ্গে গেছে পাঁজরের দু'টি হাড়। অভ্যন্তরীন কিছু জখমও ছিল। সবমিলিয়ে পুরো তিনটা মাস লেগেছিল তার সুস্থ হতে। রাজ্যের শঙ্কা নিয়ে মৌমিতা আমার দিকে তাকিয়ে বলল- আমি কোথায় যাব ? আমার হবে কি ? দাকাক্কা। এরই মধ্যে আমার বুকটা ধক করে উঠল, চোখ ভিজে এল। তৎণাৎ ডাক্তার এসে বলল- এখন আপনিই তো ওর অভিভাবক তাহলে ওই ফরমে একটা স্বার করে মৌমিতাকে নিয়ে যান। ওদিকে চিন্তায় আমার ঘুম নেই। ওই মেয়েটা কে নিয়ে কোথায় যাব ? কী করব ? নানান চিন্তায় খাওয়া-দাওয়া-ঘুম যেন পালিয়ে গেছে। বন্ধু-বান্ধব-পরিবারের সবারই উক্তি তোর কী হয়েছে ? আমি কারো কোন সঠিক জবাব দিতে পারিনা। আর ওদিকে মা, বাবাকে হারিয়ে মৌমিতা নিশ্চুপ। নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে। কান্নার ভাষা হারিযে ফেলেছে সে। মৌমিতাকে কিছুদিন মোহনগঞ্জ এক বন্ধুর বাসায় রাখলাম। তারপর সাহস করে ঢাকার এক আবাসিক স্কুলে ভর্তি করে দিলাম কাসে টুতে। প্রতিমাসে তিন হাজার টাকা দিতে হবে। টাকাটা সংগ্রহ করতে আমার খুব বেগ পেতে হত। কারণ আমার পরিবারের কেউ ওই ঘটনাটি জানতো না। অতিরিক্ত তিন হাজার টাকা আমাকে প্রতিমাসে সংগ্রহ করতে হতো। ওই অতিরিক্ত টাকা সংগ্রহ করা নিয়ে পরিবার-বন্ধুমহলসহ নানাজনের কাছে নানান প্রশ্নের সম্মূখীন হতে হয়েছে।
মনে পড়ে যেদিন মৌমিতাকে ঢাকার আবাসিক স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে গিয়েছিলাম । স্কুলের অধ্য দিলশাদ চৌধুরী মৌমিতাকে বললেন তোমার বাবার নাম কী ?
আবুল বরকত পাহা
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম মৌমিতার কণ্ঠশুনে বুঝতে পারেন ও মেয়েতো ভীষণ ব্রিলিয়্যান্ট। ম্যাডাম কিছু প্রশ্ন করলেন, মৌমিতা সব গুলোর সঠিক উত্তর দেয় যার দরুণ দিলশাদ ম্যাডামের মৌমিতার প্রতি প্রথমদিনেই দুর্বলতার একটা লণ ধরা পড়ে। গানে, নৃত্যে, আবৃত্তি ও অভিনয়ে সারা স্কুল মাতিয়ে রাখে মৌমিতা । স্কুলের চারিদিকে শুধু মৌমিতা। মৌমিতা। মৌমিতা। সংসার এবং নিজ পেশার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ঢাকায় মৌমিতার সংগে দেখা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনা। এরই মধ্যে মৌমিতা বড় হয়ে উঠতে থাকলো। চেহারাও আরো সুন্দর থেকে সুন্দর হতে থাকলো। ৫ম, ৮ম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি, এস.এস.সি. ও এইচ.এস.সিতে এ প্লাস পেল। যন্ত্রপাতির বহুল প্রচলন ও ব্যবহারের ফলে মানুষের জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে ওই ধারাবাহিকতায় মোবাইল এসে গেল বাংলাদেশে। এখন প্রতিদিন মৌমিতার সঙ্গে মোবাইলে কথা হয় । আমি তখন কুলিয়ারচর। দিলশাদ ম্যাডাম একদিন মোবাইলে বলল- আপনার মেয়েকে এবার নিয়ে যান। আমি কুলিয়ারচর থেকে ঢাকায় গিয়ে মৌমিতাকে আরেকটি হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে চলে আসি। মৌমিতা বুয়েট মেডিকেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারভিউ দিয়ে সবগুলোতেই মেধার স্বার রাখে।
মৌমিতাকে নিয়ে আরেকটি স্মৃতি না বললে তা অপূর্ণতাই থেকে যাবে। স্মৃতিটি এরকম- মৌমিতা যখন নবম শ্রেণীতে পড়তো তখন দিলশাদ চৌধুরী একদিন আমাকে ফোন করে দ্রুত ঢাকায় আসতে বলে। আমি প্রচুর ব্যস্ততার পরও ঢাকায় আসি। তিনি অফিস রুমে আমার সঙ্গে কিছু কথা বলেন। কথাগুলো এরকম- বরকত সাহেব আপনার মেয়েতো সবদিক দিয়ে বুদ্ধিমতি। অনেকদিন গত হল মৌমিতার বিরুদ্ধে কোন প্রকার অভিযোগ আসেনি। টেলিফোনে আপনাকে ব্যাপারটা বলতে পারতাম। কিন্তু আপনি অনেকদিন যাবৎ ঢাকায় আসেন না। ঢাকায় আসা হল মেয়েকেও এক নজর দেখলেন। সমস্যাটাও জানলেন। ব্যাপারটা হল মৌমিতা রাত বারটার পর উচ্চস্বরে গান গায়। গানগুলোও নাকি পঁচা।
আমি বললাম ব্যাপারটা দেখছি। এরই মধ্যে মৌমিতা হাঁপাতে হাঁপাতে তিনতলা থেকে নিচতলায় এসে বলল- দাকাক্কা! দাকাক্কা! তারপর মৌমিতাকে নিয়ে ওয়েটিং রুমে চলে গেলাম।
ওই দাকাক্কা ডাক নিয়ে দিলশাদ চৌধুরীসহ মৌমিতার বন্ধু, সেখানকার অফিস স্টাফগণ নানা মন্তব্য করলো। দিলশাদ চৌধুরী আধুনিক উচ্চশিতি হওয়ায় ব্যাপরটা নিযে এত ঘাটাঘাটি করেননি। আমি মৌমিতাকে বললাম- তুমি রাতে উচ্চস্বরে গান গেয়ে অন্যের অসুবিধা কর কেন?
-আমি তো তোমার গান গুলোই গাই ?
কোন গান ?
সে বার তোমার ডায়রিটা যে রেখে গিয়েছিলে, সেখানে তো গান গুলো আছে।
খোন্দকার নূরুল আলমের:
'কে যেন আজ আমার চোখে
নতুন আলো জ্বালিয়ে দিল ....................'
মাহমুদুন্নবীর:
'তুমি যে আমার কবিতা
আমার বাশীর রাগিনী............'
আমি মৌমিতাকে গান গাইতে নিষেধ করলাম। অনেক বুঝালাম। কিছু টাকা হাতে দিয়ে দিলশাদ চৌধুরীর রুমে ঢুকলাম। তিনি বসতে বললেন। আমি বসলাম। ম্যাডামকে বললাম মৌমিতা আর গান গাবেনা। তবে আমার একটা প্রশ্ন: মাহমুদন্নবীর গান পঁচা হলে ভালো শিল্পীটা কে?
- ম্যাডাম বললেন- শামীম-কালামের গানই তো আজ কালকার টিন এজররা শুনে।
- আমি বললাম সব সুরকার, সব গীতিকার সব কন্ঠশিল্পীদের প্রতি আমার বিশ্বাস আছে। ওই উন্নত প্রযুক্তির যুগে আরো উন্নত মানের গান আমরা নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের কাছ থেকে আশা করি গান। শুধু চাই একটু ধৈর্য, চাই গানের প্রতি দরদ, সে গুলো কী নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে আছে।
- ম্যাডামের উত্তর, আরো সহজ ভাষায় বলুন।
- আমি মনে করি গান তখনই জনপ্রিয় হয়, যখন গানগুলো সব বয়সি মানুষের মুখে মুখে ওঠে আসে। যখন গান গুলো একজন অবসর মানুষের সঙ্গী হয়, দুঃখ-কষ্ট-হাসি-আনন্দের সঙ্গী হয়।
- আপনার কথাগুলো শুনতে ভালোই লাগছে। আপনার সময় থাকলে আরো কিছু বলুন।
গান মানে স্থুল ভাবনা নয়, গান মানে স্নু চিন্তা। গান মানে শুধু নাচানাচি নয়, গান মানে উপভোগ করা, অনুভব করা।
তাহলে এখনকার গান কী গান নয়?
আমি তা বলছি না। আধুনিক গান মানেই তো বাণী প্রধান গান। গানের বাণীতে অশ্লীলতা এলো কেন ? পুরানো সেই গানগুলো বিশেষ করে মৌমিতা যে গানগুলো গায় সে গান গুলো রিমিঙ্ হচ্ছে কেন? হালের গানের কদর কমছে কেন? আজ যে গান হিট, বছর কয়েক পর সে গানগুলো তন্ন তন্ন করেও খোঁজ পাওয়া যায় না। অথচ যে গানগুলো নতুন প্রজন্ম পঁচা বলে তাদের মুখেই সে গান শোন যায়?
ম্যাডামের প্রশ্ন, একটা দৃষ্টান্ত দেন।
"ওরে নীল ধরিয়া ............" ওই ধরনের অনেক গান আছে। যেগুলো গুন গুন করে বুড়া-বুড়ি, যুবক-যুবতী, তরুণ-তরুণী, শিশু-কিশোর সবাই একটু আধটুকু গায়।
ম্যাডামের উত্তর- আমি শিক। গান নিয়ে এত চিন্তা কখনো করিনি।
তবে আমার মনে হচ্ছে আপনি একজন বিশুদ্ধ সংগীত বিশারদ। সে হিসাবে আপনাকে সাধুবাদ জানাই। ওদিকে দূর থেকে মৌমিতা সব শুনছিল। আমার এ কথা গুলো শুনে মৌমিতার ধ্যান ধারণায় আরো পরিবর্তন এল।
একদিন মৌমিতা আমাকে ফোনে বলল- দাকাক্কা আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে ভর্তি হব। আমি হ্যাঁ স্বরে জবাব দিলাম। তবে মনে মনে কষ্ট পেলাম। আমি চেয়েছিলাম ও ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হোক।
এরই মধ্যে মৌমিতা আমাকে টাকা পাঠাতে নিষেধ করল। উল্টো আমাকে টাকা দিতে চাইল। কষ্ট পাবে বলে আমি বললাম ঠিক আছে আমার নেত্রকোনা পূবালী ব্যাংকের শাখায় তুমি টাকা পাঠাবে। তোমার মোবাইলে এসএমএস করে একাউন্ট নম্বর পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমি আরো বললাম তুমি টাকা কিভাবে উপার্জন করছ? সে বলল দুটি ভালো টিউশনি পেয়েছি।
এবার অর্নাসের ফল বের হল। প্রথম শ্রেণীতে প্রথম। ওর বন্ধু মহল শিকসহ সবাই ভীষণ খুশী। আমি সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিকদের নিষেধ সত্ত্বেও মৌমিতা বিসিএস পরীক্ষা দিল। ওই প্রথম মৌমিতার সঙ্গে আমার সামান্য মতবিরোধ দেখা দিল। সে এখন নেত্রকোণায় আসতে চায়? তার কিছু দরকারী কাজ আছে। আমি নিষেধ করলাম। সে নিষেধ মানল। হঠাৎ একদিন মৌমিতা ফোনে বলল এইমাত্র বিসিএস পরীার ফল ইন্টারনেন্ট থেকে জেনেছি। আমি সহকারী জজ হিসাবে নিয়োগ পেয়েছি। তার কয়েকদিন পর আবার ফোনে জানাল ১৯ অক্টোবর ঢাকায় চাকুরীতে যোগদান করবে।
উচ্চবংশ পরিচয়ে মানুষ কখনো মর্যাদাবান হয় না। বরং কর্মময় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্যে মানুষ গৌরবান্বিত হয়। কাজের মাধ্যমে মানুষ নিজের জীবনকে সফল করে তোলে। আবার কর্মের অবদানে দেশ ও জাতির উন্নতি বিধান করে চলে। আর সেই ফলপ্রসূ কাজের জন্যেই মানুষ মানুষের স্মৃতিতে অমর হয়ে থাকে। মৌমিতার জজ হবার কথা শোনে আমার তাই মনে হল। আরেকটি বিষয় ওর মধ্যে দেখেছি অবাধ স্বাধীনতা পাবার পরও সে ইঁচড়ে পাকা হয়ে যায়নি।
দু'দিন পর আবার ফোন এল ১১ অষ্টোবর কঙ্বাজার যাবে একটা গানের উৎসবে। মাল্টিমিডিয়া কোম্পানির সৌজন্যে 'মৌমিতার একক গানের সন্ধ্যা' নামে এক জমজমাট আসরে। জাকজমটক পুর্ণ অনুষ্ঠানটা হবে পাঁচতারা হোটেলের বল রুমে। মৌমিতার মার কথা মনে পড়ল। সে তো মৌমিতাকে গান করতে নিষেধ করেছিল। আমি এক মহাসমস্যায় পড়লাম। মৌমিতাকে বললাম পরে ফোন কর। একটু পর আবার ফোন করল। মৌমিতা বলল- তুমি তো আগে কখন আমার সঙ্গে এমন করনি। তবে আজ কেন এমন করছ। আমাকে নিয়েই তো ওই অনুষ্ঠান। আমি তো কথা দিয়েছি। কিছুদিন পর জজ হব, আর তখন মানুষে বলবে কথা দিয়ে যে কথা রাখেন না, সে আবার কিসের জজ! কিসের বিচারক? নিজের হোক কিংবা পালিত হোক সন্তানের মত কী আর কোন প্রিয় বস্তু আছে এ জগতে। ভাবতে গিয়ে দ্রুত গতিতে চোখ দিয়ে জল প্রবাহিত হতে থাকল।
আমার মনে হচ্ছে- কে যেন আমার বুকে ছুরি মারছে। সেই অবস্থায় মৌমিতাকে যাবার অনুমতি দিলাম এবং আমার বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন কঙ্বাজারের বন্ধু সুলতানা ইয়াছমিন পিনার মোবাইল নম্বর দিয়ে সেখানে পৌঁছে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললাম। এবার আমি পিনার কাছে ফোন করে বিস্তারিত জানালাম।
১২ তারিখ সন্ধ্যা সাতটায় পিনা আমাকে মোবাইলে জানায় সাগর দেখতে গিয়ে মৌমিতা টেউয়ের ধাক্কায় সমুদ্রে তলিয়ে গেছে। খবরটা পাওয়া মাত্রই আমার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হবার উপক্রম হল। আমার কাছে পৃথিবীর সবকিছু অন্ধকার মনে হল। এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। ১৫অষ্টোবর সকাল নয়টায় আমার জ্ঞান ফিরল। জাতীয় একটা পত্রিকা আমার পাশেই ছিল। পত্রিকায় প্রথম পাতার প্রথম কলামের শিরোনাম- 'সদ্য বিসিএস নিয়োগ পাওয়া সহকারী জজ মৌমিতা পাহা কঙ্বাজার সমুদ্র সৈকতে নিখোঁজ'। ঘটনাটা আমার পরিবার ঘনিষ্ট আত্মীয় বন্ধু মহল কাউকে বলেনি। মৌমিতার দাকাক্কা ধ্বনি এখনও আমার কানে ধ্বনিত হয়, আর সেই পুতুলের মতো সুন্দর মূর্তি এখনও আমার হৃদয় পটে আঁকা রয়েছে। আজ আমি বড়ই কান্ত। বিধ্বস্ত। ওই ঘটনাসমূহ আমাকে ভীষণ নাড়া দিচ্ছে। রক্তচাপ বেড়ে যাচ্ছে। কী করব? কী করা উচিত তা ভেবে না পেয়ে খুবই অসহায় বোধ করছি। কী জানি সকলেই কী ঘুমিয়ে আছে? কেউ কী আমার মতো ভাবে না? জেগে নেই কি কেউই? মৃত্যুর ঠিক দু'মাস তিন দিন আগে মৌমিতা ভৈরবের পৌর মার্কেট থেকে আট হাজার দুইশত টাকা দিয়ে একটা নকিয়া ৩১১০ মোবাইল কিনে দিয়েছিল। ওর টিউশনির জমানো টাকা থেকে মোবাইলটা আমাকে গিফট করেছিল। সঙ্গে তিনশত টাকা দিয়ে একটা মেমোরি কার্ডও দিয়েছিল। আমি রবীন্দ্রনাথের 'তুমি কি কেবলই ছবি' গানটা বেশী শুনি বলে বলেছিল- তোমার মোবাইলে গানটা সেট করে দিয়েছি। মন খারাপ হলে গানটি শুনবে।
"তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা।
ওই- যে সুদূর নীহারিকা
যারা করে আছে ভীড় আকাশের নীড়
ওই যারা দিবারাত্রি............."।
এখন সুখে-দুঃখে, আনন্দ বেদনায় কী জানি কেন শুধু আমি ওই গানটাই শুনি।
লিখেছেন : আবুল কাইয়ুম আহম্মেদ
মোবাইল : ০১৭১৬৩৪৯৭২৪
No comments:
Post a Comment